এবছর মে মাসে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলায় যায় বাস্থই এর "১০০ বাড়ি প্রকল্পের" ১৫ সদস্যের জরিপ দল। স্থপতি ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যের শিক্ষক শিবু বসু'র তত্বাবধানে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রান্তিক গ্রামবাসীর ঘর পরিদর্শন করে এ দলটি।
আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে বাস্থই এর সংগ্রহ করা বিশেষ ফান্ড ব্যবহার করে ও 100 HOMES DESIGN TEAM এর মাধ্যমে ডিজাইন করে মোট ৭ টি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। সকল পর্যায়ে স্থানীয় কমিউনিটিকে নিয়ে স্থপতি শিবু বসুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এ ঘরগুলো নির্মিত হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে এটি তৈরি করতে বাস্থইয়ের পুরো টিমের ভ্রমণ, থাকাখাওয়া ও তত্ত্বাবধানের সার্বিক খরচ সংশ্লিষ্ট সকল স্থপতিরা তাদের নিজস্ব পকেট থেকে খরচ করেছে, এসব খরচের ক্ষেত্রে ঘরের জন্য ডোনেশনের টাকা হতে বা বাস্থই হতে কোন টাকা নেয়া হয়নি।
ডিজাইন টিমের কয়েকজন সদস্যদের নাম এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে :
স্থপতি শিবু বসু
(গ্রামীণ স্থপত্যের উপর পিএইচডি রত)
স্থপতি ড : মাসুদ রশিদ
(দক্ষিণ বঙ্গের গ্রামীণ স্থপত্যের উপর পিএইচডি প্রাপ্ত, বিভাগীয় প্রধান সাইথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়)
স্থপতি বিকাশ সাউদ আনসারি
(প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি)
স্থপতি মাহফুজুল হক জগলুল
(চেয়ারম্যান, সোসাল রেস্পন্সিবিলিটি কমিটি)
স্থপতি শেখ মো: রেজোয়ান
(সহ বিভাগীয় প্রধান, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি)
প্রখ্যাত প্রকৌশলী শামসুল আলম বিটু
এছাড়া স্থপতি কাজি নাসির (প্রাক্তন প্রাধান স্থপতি DOA ও বাস্থই এর প্রাক্তন সভাপতি) বিভিন্ন পর্যায়ে ডিজাইন টিমের উপদেষ্টা হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন জুনিয়র স্থপতি ও ছাত্র এ দলে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
প্রকল্প ডকুমেন্টেশন ও সার্ভে রেকর্ড এর দায়িত্বে:
স্থাপত্য বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
স্থপতি অধ্যাপক শেখ সেরাজুল হাকিম উপল
(বিভাগীয় প্রধান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
সহযোগিতায়: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন মাস্টার্সের ছাত্র
ডিজাইন টিম প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিটি প্রকল্পে কিছু কিছু নতুন বিষয় ডিজাইনে গবেষণা হিসেবে সংযুক্ত করা হবে। এ প্রকল্পে যে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয় সেগুলো হচ্ছে :
১.
দক্ষিণ বঙ্গের এ অঞ্চলটি যেহেতু অত্যন্ত উঁচু জোয়ার ও রেকর্ড জলচ্ছাসের জন্য সুপরিচিত তাই সিদ্ধান্ত হয় যে ঘরের প্লিন্থের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য মাটির প্লিন্থের চারপাশে একটি ইটের পরিবেষ্টন দেয়া হবে যাতে উঁচু জোয়ার ও জলচ্ছাস এবং স্বল্পমেয়াদী জলমগ্নতায় প্লিন্থ নিরন্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে না পারে। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম বিটু ইটের এ পরিবেষ্টনটি ডিজাইন করেন। এ পরিবেষ্টনটির যে যে স্থানে কাঠের খুটি বসেছে সেখানে কংক্রিটের বেসের ব্যবস্থা করা হয়েছে যার সাথে খুটিগুলো লোহার ধাতব পাতের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে যেনো ঝড়ের সময় ঘরটি স্থানচ্যুত না হতে পারে কেননা এ অঞ্চলটি সিডর, আইলাসহ অতীতের বহু ভয়াবহ ঝড় ও জলচ্ছাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত।
২.
দ্বিতীয় যে জিনিসটি এখানে করা হয় সেটা হচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উডটেকনলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড.নজরুল ইসলামের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও স্থপতি শিবু বসুর সহযোগিতায় স্থানীয় লাগসই প্রযুক্তি ও ট্রিটমেন্ট ট্যাংক নির্মাণ করে কাঠকে ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করা যেনো এখানে ঘরগুলোতে ব্যবহৃত কাঠের স্থায়িত্ব বাড়ানো যায়।
৩.
তৃতীয় যে জিনিসটি এখানে করা হয় সেটা হচ্ছে আউটার পার্টিশনে সি আই শিট ব্যবহার কমিয়ে সেখানে কাঠের ব্যবহার বাড়ানো ও ভেন্টিলেশনের জন্য কাঠের মধ্যে সছিদ্র জালির ব্যবহার করা যেনো ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা কম থাকে।
৪.
এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার বিটু সাহেব স্থানীয় মাটির সাথে ৫% সিমেন্ট মিশেয়ে জোয়ারের পানি সহনীয় মাটির প্লিন্থ বানানোর জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ডিজাইনের ক্ষেত্রে ঘরের পার্শ্ববর্তী খাল, বিল, নদী, অন্যান্য জলাধার, গাছপালা, ঘরের ওরিয়েন্টেশন, এলাকার অতীত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস ও রেকর্ড, তাদের পারিবারিক ও আর্থিক বাস্তবতা ও আসেপাশের কমিউনিটি ও তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অবস্থান ও আন্তসম্পর্ককে বিশেষ ভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
আরো অনেক সৃজনশীল আইডিয়া হয়ত এখানে সন্নিবেশিত করা যেতে পারতো, তবে আমরা চাচ্ছি একই প্রজেক্টে অনেকগুলো নতুন আইডিয়া নিয়ে গবেষণা না করা বরং ধিরে ধিরে অগ্রসর হওয়া।
কমিউনিটি পার্টিসিপেশন :
সম্পূর্ণ প্রকল্পসহ এ ঘরটি বাস্তবায়নে এলাকার সাধারণ জনসাধারণ অর্থাৎ লোকাল কমিউনিটির পার্টিসিপেশন ছিলো অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত প্লিন্থের মাটি ভরাটের কাজটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় কমিউনিটি স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে করে দেয়।
পুরো ৭ টি ঘর করতে যে কাঠের প্রয়োজন হয় তা স্থানীয় কমিউনিটি পুরো এলাকা ঘুরে ভালো গাছ নির্বাচন করে তা থাকে খুব সুলভ মূল্যে ভালো মানের পাকা কাঠ সংগ্রহ করে দেয়।
এছাড়া পূর্বে উল্লেখিত কাঠের ট্রিটমেন্ট করার ক্ষেত্রেও স্থানীয় জনগণ পরিপূর্ণ ভাবে এগিয়ে আসে ও সহযোগিতা করে।
অনেক ঘরের প্লিন্থে যে লাল রঙের অক্সাইড ব্যবহার করে প্লিন্থকে সুন্দর করার চেষ্টা হয়েছে বা কাঠের উপর নানা লোকজ ডিজাইনের জালির কারুকাজ করা হয়েছে তাও কমিউনিটির সদস্যরা নিজেরা স্ব প্রণোদিত হয়ে করেছে, বাস্থইয়ের ডিজাইন টিম এখানে ইন্টারফেয়ার করেনি। দিনশেষে ঘরের যে ডিজাইনটি দাঁড়িয়েছে সেটা হচ্ছে বাস্থইয়ের ডিজাইন টিম ও স্থানীয় ভার্নাকুলার উইসডম এবং কমিউনিটির সম্মিলিত চিন্তাভাবনা ও অংশগ্রহণের ফসল। স্থানীয় জনগনের aesthetic sense কে আমরা সম্মান দিতে চেয়েছি ও একে নতুন চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছি।
আমাদের পরের প্রজেক্ট হচ্ছে ভোলার ২১ টি ঘরকে নিয়ে, ইতিমধ্যেই প্রায় ৩০ সদস্যের বাস্থইয়ের একটি দল ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চল সমূহ পরিদর্শন করেছে। এ প্রজেক্টে ডিজাইন টিমে স্থপতি আবদুস সোবহান, স্থপতি কাজি আরিফ,স্থপতি বায়েজিদ খন্দকার, স্থপতি আলমগীর জলিল, স্থপতি প্রতীক বড়ুয়াসহ আরো অনেকে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। যে কোন স্থপতি চাইলে এ প্রজেক্টগুলো সাথে সংযুক্ত হতে পারেন ও এদেশের যে কোন নাগরিক চাইলে আর্থিক ভাবে আমাদের এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। আপনাদের সবাইকে আবার আহ্বান জানাচ্ছি 100 HOMES এর টিমে অংশগ্রহণের জন্য।
ধন্যবাদ